রাজধানীর কদমতলী ও শ্যামপুর থানা এলাকায় মাদকের জমজমাট ব্যবসা চলছে। দিনের বেলায় চাঁদাবাজি, রাতের বেলায় মাদকের বেচাকেনা চলে ভোর পর্যন্ত। এই এলাকার বেশিরভাগ রাস্তাঘাট সরু। কোন কোন জায়গায় হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বেশিরভাগ এলাকায়। এর ওপর রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। সেখানে এমন কোন অপরাধ নাই যা ঘটে না।
প্রতিনিধি সরেজমিনে গিয়ে দেখেছেন, কদমতলী ও শ্যামপুর এলাকাটি যেন মাদকের স্বর্গরাজ্য। প্রতিটি গলিতে অল্প বয়সী তরুণদের ভিড়। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত এসব গলিতে মাদকের বেচাকেনা চলে। এলাকাবাসী বলেন, একেক জন ইয়াবা ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকার মালিক। তারা বলেন, এখানে প্রতি রাতে কয়েক কোটি টাকার ইয়াবা বিক্রি হয়। ছাগলকান্ডে জড়িত এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউরের মতো টাকার মালিক এখানকার মাদক ব্যবসায়ীরা। সাধারণত সন্ধ্যার পর এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেউ আসেন না। তবে তারা গাড়ি নিয়ে বড় রাস্তায় থাকেন। মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ভাগের টাকা প্রতিদিন পৌঁছে দেন।
জানা গেছে, কদমতলী ও শ্যামপুর এলাকায় মাদক ব্যবসার নেপথ্যে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। এজন্য পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের গাছাড়া ভাব। পান নিয়মিত বখরা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পুলিশ মাঝে মধ্যে এসব স্পটে অভিযান চালালেও মূল হোতা কখনও ধরা পড়ে না। মাঝে মাঝে ধরা পড়ে বিক্রেতা ও সেবনকারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ছেড়ে দেয়।স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, এই এলাকার পুরো মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় একজন নেত্রী। তিনি আশপাশেই থাকেন এবং মোবাইল ফোনে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউ গ্রেফতার হলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন এই নেত্রী। এই নেত্রীর সঙ্গে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সখ্য রয়েছে। সে কারণে এক যুগ ধরে তিনি দোর্দন্ড প্রতাপে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন চায়না খালা নামে আরেকজন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইচ্ছা করলে সহজেই এখানকার মাদকের স্পটগুলো বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু মোটা অংকের টাকা পায় বলে পুলিশ সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করে। অভিভাবকরা বলেন, প্রকাশ্যে মাদক বেচনাকেনা হয়। সন্তানদের পাহারা দিয়েও মাদকের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। পিতার চোখের সামনে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সন্তান। অনেক সময় মাদক কেনার টাকা না পেয়ে সন্তানের হাতে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন অনেক বাবা-মা। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সেখানে তারা অভিযানে গিয়ে উল্টো হামলার শিকার হয়েছেন। সাধারণত রাতের বেলা অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। এই এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন একজন নেত্রী। যার দুই আত্মীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মরত। আরেকজন আছেন চায়না খালা। এরা হলো এই এলাকার মাদক ব্যবসার মূল হোতা। এই ব্যবসার ভাগ যথাস্থানে নিয়মিত পৌঁছে দেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘কদমতলী ও শ্যামপুর এলাকাটিতে এমন অবস্থা বিরাজ করছে, সেখানে ঠিকমতো অভিযানে যাওয়া যায় না। অলি-গলি পথে অভিযানে গেলেও মরিচের গুঁড়া নিক্ষেপ করে। পরে সেখান থেকে ফিরে আসতে হয়। তারপরেও মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা থেমে থাকব না। আমরা অন্য কায়দা অবলম্বন করে দ্রুত ওই এলাকায় মাদক নির্মূলে অভিযান পরিচালনা শুরু করব।’
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থারও একই বক্তব্য। তারা বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি আলমবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় যেতে পারে না। সব জায়গা থেকে এখানে মাদক আসে। বেশিরভাগ ইয়াবা। এখান থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়।
এদিকে এলাকায় মুসল্লিদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, এই দুই থানা এলাকার ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে দুই লক্ষাধিক লোকের বাস। এই দুটি থানার অধীন আলমবাগ, শ্যামপুর বস্তি, নামা শ্যামপুর, খন্দকার রোড, পোস্তগোলা, জুরাইন, ইসলামবাগ এবং রেললাইনের দুই পাশে দিনের বেলা ছোটখাট ব্যবসা বাণিজ্য চলে। এছাড়া ব্যাটারি চালিত প্রতিটি গাড়ি থেকে নির্ধারিত হারে টাকা নেওয়া হয়। আমরা রাজধানীর পাশে থাকলেও মনে হয় বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে বাস করছি। একদিকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং অন্যদিকে চরম নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে বাস করছি। সরকারের বিভিন্ন জায়গায় এসব বিষয়ে আবেদন করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি। রাস্তাঘাটের কোন উন্নয়ন হয়নি। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মাদক ও অপরাধীদের সঙ্গে বাস করতে হচ্ছে আমাদের।এসব বিষয়ে কথা বলতে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তাই শ্যামপুর ও কদমতলী থানাধীন এলাকার মাদক নির্মূলে ও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনভাবেই ওই এলাকায় মাদক ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না।’