ব্যাংকের অসহযোগিতায় কারণে ঋণ খেলাপি ঘোষণা করা হয় বলে অভিযোগ মালিকপক্ষের।কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু এই প্রতিষ্ঠান নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে গত ৩ আগষ্ট পর্যন্ত গাজীপুরের ১০৬টি কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে নিজ নিজ কারখানা কর্তৃপক্ষ। এতে বেকার হয়েছেন ৭৮ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী।
কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টিসহ মাহমুদ জিন্স, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটিল ফ্যাশন, ক্লাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলস, টি আর জেড গার্মেন্টস, রোয়া ফ্যাশনন্সসহ বিজিএমইএভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠান।
বেকার এসব শ্রমিক অনেকে কাজ না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। চাকরি ছেড়ে অটোরিকশা চালনা, ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনাসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। নারী পোশাক শ্রমিকদের মধ্যেও অনেকে অন্যত্র গিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছেন। অনেকে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আবার অনেকে গাজীপুরে থেকে টেইলারিং, কাপড়ের দোকানসহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে গাজীপুরে শ্রমিকপল্লীতে চলছে হাহাকার। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
এ বিষয়ে টি আর জেড গার্মেন্টস শ্রমিক সালেহা বেগম বলেন, ‘দীর্ঘ ১০ বছর এই কারখানায় কাজ করছি। এখন কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে কষ্টে আছি। নতুন কারখানায় যোগ দিতে পারি নাই। আগের মতো সুযোগ-সুবিধা না পেলে চাকরি করে কী হবে।’
এদিকে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া এবং বকেয়া বেতনের দাবিতে প্রায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকেরা। তারা ভাঙচুর, বাসে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটান। এতে প্রায় সড়ক-মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়েন যানবাহনের চালক, যাত্রী ও পথচারীরা।
শুধু শ্রমিক নয়, কারখানা বন্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন এলাকায়। কারখানা এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি ভাড়াসহ নানা ক্ষুদ্র পেশায় ধস নেমেছে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাড়া বাসা বদল করে অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়েছেন অনেকে।
কেয়া গ্রুপের সামনে কথা হয় কয়েকজন দোকানীর সঙ্গে। তারা জানান, আগে তাদের দিনে ১২-১৫ হাজার টাকা বেচাকেনা হতো। এখন ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে পরিবার নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের।
জরুন এলাকার মুদি দোকানি রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আগে প্রতিদিন দোকানে ১০-১৫ হাজার টাকা বিক্রি হতো এখন সেটি ১-২ হাজারে নেমে এসেছে। এলাকায় আগের মতো বেচাকেনা নেই।’
গাছা এলাকার বাড়িওয়ালা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এক সময় বাসা ভাড়ার জন্য প্রতিদিন লোক আসতেন। এখন ভাড়াটিয়ার চাপ কমে গেছে। অনেকের বাসা খালিও থাকছে। এ অবস্থায় বাড়িতে বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে সমস্যা হচ্ছে।’
বিজিএমইএ ও পোশাক কারখানা মালিকেরা বলছেন, জ্বালানি সংকট নিরসনের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও কারখানা চালুর বিষয়ে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
এ নিয়ে এসি শিল্প এস্টেট ও স্টাইলিশ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ব্যাংকের সহযোগীতা পাচ্ছে না মালিকেরা। ফলে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে, বেকার হয়ে পড়েছে শ্রমিকেরা। অনেকেই গ্রামে চলে গেছে। এটা অর্থনীতির জন্য খারাপ খবর। ব্যাংক সহায়তা, পোর্ট সুবিধাসহ এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন।’
কারখানা বন্ধ ঘোষণা করায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা। ছবি: ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনঅন্যদিকে তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ায় অনেক শ্রমিক চুরি, ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে বলে মনে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর গাজীপুরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এখানকার শ্রমিক শ্রেণি যাদের পেটে ভাত বা খাবার যোগান করতে পারেনি, তারা রাস্তায় বেরিয়ে ছিনতাই বা অন্য অপরাধে জড়িয়ে যায়। কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলে যে কোনো জায়গায় অপরাধ বেড়ে যায় এটা স্বাভাবিক। কারখানা বন্ধ হওয়াটাকে আমরা হুমকি মনে করছি। ৫ আগস্টের পর বেকার শ্রমিকদের একটি অংশ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে।’
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আল মামুন শিকদার বলেন, ‘মালিকানা পরিবর্তন, ব্যাংকঋণ রিশিডিউল না করা, কাজ না থাকা ইত্যাদি কারণে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। তবে আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হচ্ছে বেশিরভাগ কারখানা।’
মালিক-শ্রমিক ও শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ছোট-বড় ৫ হাজার কলকারখানা রয়েছে যার মধ্যে দুই হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কারখানা। এর মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যা এক হাজার ১৫৪টি