বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা অতিতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। দেশের তাপমাত্রা এ বছর প্রায় ৪৫ ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেলেছে। তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেশের পোলট্রি শিল্পের জন্য মারাত্মক হুমকি। ব্রয়লার মুরগির দ্রুত বৃদ্ধিহার, উচ্চ দৈহিক ওজন, উচ্চ খাবার রূপান্তর হারের ফলে দেহে প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপাদন করে। তাই পরিবেশের উচ্চ তাপ ব্রয়লারের জন্য খুবই সংবেদনশীল। হিট স্ট্রেসের ফলে ব্রয়লার মুরগির খাবার গ্রহণের পরিমাণ, কম খাদ্য রূপান্তর হার এবং বৃদ্ধি কমে যায়। এছাড়া বেশি সময় ধরে হিট স্ট্রেসে থাকা ব্রয়লারের মাংসে প্রোটিনের পরিমাণ কমে যায়, ব্রেস্ট পেশির মাংসের আকার ছোট হয়ে যায় এবং মাংসে চর্বির পরিমাণ বাড়ে। এমনকি মুরগির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক ব্রয়লারের খাবারে অতিরিক্ত হিসেবে আমলকি ফলের পাউডার প্রয়োগ করে হিট স্ট্রেস মোকাবিলায় সফলতা পেয়েছেন। গবেষক দলের প্রধান এবং বাকৃবির প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. চয়ন গোস্বামীর নেতৃত্বে ঐ গবেষণাসংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র সম্প্রতি ইউরোপিয়ান জার্নাল অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড ফুড সায়েন্সেসে প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ঐ গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে।
গবেষণা দলে আরো ছিলেন পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বাপন দে, ইন্টারডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটির (আইআইএফসি) সহযোগী অধ্যাপক ড. রাখি চক্রবর্তী এবং প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. কামরুল হাসান কাজলসহ স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা।
অধ্যাপক ড. চয়ন গোস্বামী বলেন, আমলকী ফলে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিস্ট্রেস ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণাগুণ রয়েছে এবং এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। হিট স্ট্রেসের প্রভাবে ব্রয়লার মুরগি খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয়। পরিবেশের তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৮ পর্যন্ত প্রতি ডিগ্রি বৃদ্ধিতে ব্রয়লারে খাবার গ্রহণের পরিমাণ ৪.৬ ভাগ হারে কমতে থাকে। খাদ্যগ্রহণ কমে গেলে দেহে স্ট্রেস হরমোন ক্ষরণ বেশি হয় যা ব্রয়লারের দেহে কর্টিকোস্টেরয়েডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর এই কর্টিকোস্টেরয়েডের দেহের প্রোটিনকে ভেঙে দেয়। ফলে পরিপাকতন্ত্র ও খাবার হজমে বাধা সৃষ্টি করে। এজন্য মুরগির বৃদ্ধি কম হয় এবং ওজন হ্রাস পায়।
আমলকি ক্ষুধা বিবর্ধক হিসেবে কাজ করে, খাবার গ্রহণের পরিমাণ বাড়িয়ে এগুলো প্রতিরোধ করে। এছাড়া এটির ব্যবহার ফ্রি-র্যাডিক্যাল হ্রাস করে এবং খাদ্য রূপান্তর হার বাড়িয়ে দেহে খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে ওজন বৃদ্ধির ভারসাম্য ঠিক রাখে। ফলে ব্রয়লার মুরগিতে অতিরিক্ত হিসেবে এটির ব্যবহার ব্রয়লারের হিট স্ট্রেসজনিত ক্ষতি মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে।
তিনি আরো বলেন, দৈনিক খাবারের সঙ্গে আমলা ফলের পাউডার সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ব্রয়লারে খাওয়ালে ব্রয়লারের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি, খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং মৃত্যুহার কমাবে। এছাড়া এটা প্রয়োগে ব্রয়লারের দেহে কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, এলডিএলের মতো খারাপ ফ্যাট কমিয়ে এইচডিএলের মতো ভালো ফ্যাট বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
গবেষক আরো জানান, বর্তমানে দেশের পোলট্রি শিল্প হিট স্ট্রেসের ক্ষতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা ব্রয়লারের উত্পাদন হ্রাস এবং মানসম্মত মাংস উত্পাদনে বড় বাধা। জেনেটিক রূপান্তর, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, নিবিড় বায়ুপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও কক্ষ আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের মতো ব্যয়বহুল প্রযুক্তি হিট স্ট্রেস কমাতে ব্যবহার করা হলেও বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ছোট ও মাঝারি খামারগুলোতে এগুলো ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এছাড়া রাসায়নিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিট স্ট্রেস কমাতে ব্যাপক হারে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু এসব অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। তাই হিট স্ট্রেস মোকাবিলা করতে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হতে পারে নির্ভরযোগ্য সমাধান। গবেষণার ব্যাপারে অধ্যাপক ড. বাপন দে বলেন, আমলা ফলের অ্যান্টিবায়োটিক গুণও রয়েছে। এটি পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্রে উপকারী ল্যাকটোব্যাসিলি ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা ল্যাকটিক অ্যাসিড উত্পাদন করে। এজন্য ই-কোলাই, সালমোনেলার মতো গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এজন্য প্রাকৃতিক আমলকি অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।