সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশে বসে ‘বোতাম টেপেন’, আর ঘটনা ঘটে ঢাকায়। অপরাধজগৎ ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কোথাও মিলেমিশে, কোথাও মুখোমুখি অবস্থানে থেকে তৎপরতা চালাচ্ছেন।
ঢাকার ৩০ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অতীত কার্যক্রম ও বর্তমান অবস্থান নিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সন্ত্রাসীদের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। কারাগারে আছেন ৭ জন। ১৭ জন বিদেশে অবস্থান করছেন। ২ জন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যাঁরা বিদেশে পলাতক, তাঁদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে তাঁদের হয়ে দেশে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাইম আহমেদ, সাবেক কমিশনার, ডিএমপি
২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় এই ৩০ সন্ত্রাসীর মধ্যে ২৩ জনের নাম ছিল।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে, বিদেশে থাকা ১৭ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্তত ৯ জন এখনো ঢাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছেন। গত দুই বছরে অন্তত ১৯টি বড় অপরাধ সংঘটনে এঁদের সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এর বাইরে ছোট ছোট আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন থানায় অন্তত ৩১টি মামলা, সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও অভিযোগ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সব তৎপরতার মূল লক্ষ্য চাঁদাবাজি। বিদেশে থাকা সন্ত্রাসীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, মালিবাগ, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও মিরপুর এলাকায়। এঁদের কারও কারও রাজনৈতিক যোগাযোগও রয়েছে।
চাঁদাবাজির জন্য সন্ত্রাসীদের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যে পরিণত হতে দেখা গেছে ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা, জমি ক্রয়-বিক্রয়, স্থাপনা নির্মাণ, ঠিকাদারি কাজ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও পোশাক কারখানাকে। এর বাইরে ফুটপাত, বাজার, বাড়ির মালিক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং মাদক কারবারিও তাঁদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সব তৎপরতার মূল লক্ষ্য চাঁদাবাজি। বিদেশে থাকা সন্ত্রাসীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, মালিবাগ, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও মিরপুর এলাকায়। এঁদের কারও কারও রাজনৈতিক যোগাযোগও রয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, চাঁদাবাজির জন্য শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুসারীদের একটা অংশ প্রাথমিকভাবে চাঁদাবাজির জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র খোঁজে। এ জন্য ব্যবসা বা কাজের মালিক বা নিয়ন্ত্রক এবং তাঁর পরিবারের মুঠোফোন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর দলনেতা কিংবা তাঁদের অনুসারীদের কেউ ইন্টারনেট নম্বর বা বিদেশি নম্বর থেকে চাঁদা চেয়ে ফোন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ওই ব্যক্তি ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে সংগ্রহ করা তথ্যগুলো উল্লেখ করে হত্যার হুমকি দেন। এতেও চাঁদা না মিললে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে হামলা, গুলি বা ককটেল ফাটানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ভয়ে পুলিশকেও জানাতে চান না।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মিরপুরের রূপনগর এলাকার ইস্টার্ন হাউজিংয়ে আনিসুর রহমান (মন্টু) নামের এক ব্যবসায়ীর ছেলে মিজানুর রহমানকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এর তিন মাস আগে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ পরিচয়ে বিদেশি একটি ফোন নম্বর থেকে কল করে আনিসুরের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়।
আনিসুর রহমান ৭ মে জানান, ছেলেকে লক্ষ্য করে গুলির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার ফোন করে চাঁদা চায়। অন্যথায় তাঁর দুই ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তিনি বলেন, ‘গুলির ঘটনার তদন্তে একদিন পুলিশের মিরপুর বিভাগের দুজন কর্মকর্তা আমার সামনে ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তখন আমাকে ফোন করে। ফোন ধরে লাউড স্পিকার চালু করলে ফোনের ওপার থেকে বলা হয়, ‘‘তোর সামনে তো পুলিশ। তারা কিছুই করতে পারবে না।” বোঝা গেল, সন্ত্রাসীরা আমাকে নজরদারি করেছে। এ জন্য তাদের আলাদা লোকও রয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এভাবে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে এখনো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে কোটি কোটি টাকার চাঁদা ওঠে। এর বড় অংশই যায় বিদেশে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পকেটে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, পলাতক সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরাতে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা আছে। তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী পরিচয়ে কিছু ফোন কলের কথা মাঝেমধ্যে শোনা যায়। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায়, পলাতক সন্ত্রাসীদের পরিচয়ে বিদেশি নম্বর দিয়ে অন্য কেউ ফোন করে হুমকি দিচ্ছে। এরপরও
যদি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা থাকে, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।’
নেব।’
গুলির ঘটনার তদন্তে একদিন পুলিশের মিরপুর বিভাগের দুজন কর্মকর্তা আমার সামনে ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তখন আমাকে ফোন করে। ফোন ধরে লাউড স্পিকার চালু করলে ফোনের ওপার থেকে বলা হয়, ‘‘তোর সামনে পুলিশ ওরা কিছুই করতে পারবেনা।
মিরপুরের রূপনগর এলাকার ইস্টার্ন হাউজিংয়ে আনিসুর রহমান
মুখোমুখি মতিঝিলের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা
মতিঝিল এলাকার অপরাধজগতের আলোচিত নাম জাফর আহমেদ ওরফে মানিক ও জিসান আহমেদ। পুলিশের তথ্য বলছে, ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপের মামলার আসামি মানিক। বর্তমানে তাঁর অবস্থান কানাডায়। আর জিসান ২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে দুই পুলিশ হত্যা মামলার আসামি। ওই ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে ২০০৫ সালে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। এখন তাঁর অবস্থান দুবাইয়ে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এই দুজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিশ’ জারি করা আছে।
চলতি বছরের শুরুতে বাড্ডা থেকে জিসানের নামে চাঁদাবাজির সময় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে ২০১৪ সালে মানিকের বড় ভাই ফারুক আহমেদ, জিসানের সহযোগী আবিদ হোসেন ওরফে সৈকতসহ তাঁদের সহযোগীরা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরও আগে ২০০৯ সালে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন জিসানের সেকেন্ড–ইন–কমান্ড হিসেবে পরিচিত কামরুল ইসলাম ওরফে বাপ্পী ওরফে মিয়া ভাই।
মানিক ও জিসান বিদেশে বসেই অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ নিয়ে দুজন দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন।
অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে আলোচিত এই খুনের ঘটনায় জিসানের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। এই ঘটনায় জিসানের অনুসারীদের অনেকে গ্রেপ্তার হন।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খানকে (মিল্কি) গুলশানে গুলি করে খুন করা হয়। এরপর মতিঝিল এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলামের (টিপু) হাতে। এরপর ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। তখন মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জিসান ও টিপুর হাতে। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ শাহজাহানপুরে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় টিপুকে।
অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে আলোচিত এই খুনের ঘটনায় জিসানের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। এই ঘটনায় জিসানের অনুসারীদের অনেকে গ্রেপ্তার হন। অপর দিকে খালিদ জামিনে বের হলেও মামলা থেকে নিস্তার পেতে তিনি আপাতত চুপচাপ রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিক মতিঝিল ও শাহজাহানপুর এলাকার অপরাধজগতে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
করছেন।
টিপুকে খুন করার পর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশ থেকে আমাকে অনবরত হুমকি দিয়েছে। পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছি।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম