বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে উত্তাল ছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাস। এ সময় দেশের ১৭টি কারাগারে নজিরবিহীন বন্দিদের বিদ্রোহ, হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ সেই ঘটনায় দুটি কারাগারের সব বন্দিসহ পাঁচটি কারাগার থেকে ২ হাজার ২৪৭ জন বন্দি পালিয়ে যান। একবছর পেরিয়ে গেলেও এখনও ৭১৬ জন বন্দিকে গ্রেফতার করতে করা যায়নি। তাদের মধ্যে ৯ জন জঙ্গিসহ ৯৯ জন সাজাপ্রাপ্ত আসামি, ৮৪ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রয়েছে। সেসময় বিদ্রোহ ঠেকাতে দুটি কারাগারে কারারক্ষীদের গুলিতে মারা যান ১৩ জন বন্দি। আর কারারক্ষীসহ আড়াই শতাধিক মানুষ আহত হন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।সে সময় নরসিংদী ও শেরপুর কারাগার থেকে বন্দি পালানোর পাশাপাশি রাইফেল, শটগান ও মেশিন গানসহ ৯৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৯ হাজার গোলাবারুদ লুট করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ৬৫টি অস্ত্র উদ্ধার করা গেলেও এখনও ৬ হাজারের বেশি গোলাবারুদ অপরাধীদের হাতে রয়ে গেছে।২০২৪ সালের ১৯ জুলাই প্রথম হামলাটি হয় নরসিংদী জেলা কারাগারে। সেদিন কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী কারাগারে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। সেই সুযোগে কারাগারে থাকা ৯ জন জঙ্গিসহ ৮২৬ জন বন্দিই পালিয়ে যান। এরমধ্যে চারজন রাজধানীর হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। ওই সময় কারাগারের বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংসের পাশাপাশি ৮৫টি অস্ত্র ও ৮ হাজারের বেশি গোলাবারুদ লুট করা হয়। এরপর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন জেলার অন্তত ১৭টি কারাগারে একযোগে হামলা, বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের ঘটনা ঘটান বন্দিরা। সেই সময় বন্দিদের বিদ্রোহ ঠেকাতে জামালপুর ও গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে কারারক্ষীদের গুলিতে নিহত হন ১৩ জন বন্দি। গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রাপ্ত এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে কারা অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট কারাগারগুলো।কারা সূত্র বলছে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নরসিংদী কারাগার ছাড়াও ১৬টি কারাগারে বন্দিরা বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ করেছিলেন। এরমধ্যে নরসিংদী ও শেরপুর কারাগারের সব বন্দিসহ পাঁচটি কারাগার থেকে মোট ২ হাজার ২৪৭ জন বন্দি পালিয়ে যান। একইসঙ্গে ওইসব কারাগার থেকে লুট করা হয় অস্ত্র, গুলি, গোলাবারুদ, চাল-ডাল এমনকি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও। শেরপুর ও নরসিংদী কারাগারের সব নথি আগুনে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ফলে এই দুই কারাগারের বন্দিদের বিস্তারিত তথ্য নেই কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। যদিও পরে পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের নামে থাকা মামলা ও আদালত সূত্রে তথ্য সংগ্রহ করছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।নরসিংদী জেলা কারাগারের জেলার (ভারপ্রাপ্ত) হুমুয়ান কবীর বলেন, ‘বিদ্রোহের পর কারাগারে থাকা ৮২৬ জন পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে আত্মসমর্পণ করেন ৬৪৬ জন এবং গ্রেফতার করা হয় ৩৮ জনকে। এখনও ১৪২ জন পলাতক। তখন কারাগার থেকে ৮ হাজার ১৫টি গুলি ও গোলাবারুদ লুট হয়, যা পরবর্তী সময়ে এক হাজার ৬৮০টি উদ্ধার করা হয়েছে।’সাতক্ষীরা কারাগারের ডেপুটি জেলার মো. মনির হোসেন
বলেন, ‘গত বছর সরকার পতনের পর সাতক্ষীরা জেলা কারাগার থেকে ৫৯৬ জন বন্দি পালিয়ে যান। তবে পরে তাদের মধ্যে ৫০৯ জন স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন এবং ৪৪ জন বন্দিকে গ্রেফতার করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এখনও ৪৩ জন বন্দি পলাতক রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও ১২ জন বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামি।
কারা-সংশ্লিষ্টরা জানান, ৬ আগস্ট সকালে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দিরা বিক্ষোভ শুরু করেন। এসময় তারা জেলের ভেতরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালান। ৭ ও ৮ আগস্ট বন্দিরা দেয়াল টপকে পালাতে গেলে কারারক্ষীরা গুলি চালালে নিহত হন ৬ জন বন্দি। এরপরও সেখান থেকে ৮৮ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ ২০২ জন বন্দি পালিয়ে যান। এরমধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৬১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনও পলাতক রয়েছেন ১৪১ জন বন্দি। তাদের মধ্যে ৪৫ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে।
কুষ্টিয়া কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ আব্দুর রহিম বলেন, গত বছরের ৭ আগস্ট কুষ্টিয়া কারাগার থেকে ১০৫ জন বন্দি পালিয়ে যান। এরপর বিভিন্ন সময় আত্মসর্ম্পণ ও গ্রেফতার করা হয় ৮৯ জনকে। এখনও পলাতক রয়েছেন ১৬ জন বন্দি। এরমধ্যে সাজাপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন তিনজন।
শেরপুর জেলা কারাগারের জেলার (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আবউল সেলিম বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকালে শেরপুর জেলা কারাগারে প্রধান ফটক ভেঙে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। এ সুযোগে জেলে থাকা ৫১৮ বন্দি পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ১৪৪ জন বন্দিকে গ্রেফতার করেছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছে পুলিশ। ওই সময় কারাগার থেকে যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করা হয়েছি, কিছু গুলি ছাড়া সব উদ্ধার করা হয়েছ।’
কারা সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর সারা দেশের আটটি কারাগার বিদ্রোহীদের হাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার, নরসিংদী, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ও শেরপুর জেলা কারাগার।
কারা অধিদফতরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন ও মিডিয়া) মো. জান্নাত উল ফরহাদ বলেন, ‘পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে এক হাজার ৫৩১ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে আনা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে।’
কারাগার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি
কারা অধিদফতর জানায়, বিগত সময়ে কারাগারগুলোতে বন্দিদের বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করা হতো। কিন্তু কোনও সেন্ট্রাল সার্ভার ছিল না। ফলে কারাগারের নথিপত্র পুড়ে যাওয়ায় অনেক বন্দির পরিচয় নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বন্দিদের ছবি, ফিঙ্গার প্রিন্টসহ কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল সার্ভারে ছবিসহ তথ্য রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পালাতকদের মধ্যে কারা রয়েছেন?
পাঁচটি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে এখনও হদিস মেলেনি ৭১৬ জনের। এরমধ্যে জঙ্গিসহ ৯৯ জন সাজাপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ৮৪ জন। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে চার জন মৃত্যুদণ্ডসহ ৯ জন সাজাপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে। এছাড়া পলাতকদের মধ্যে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বিচারাধীন ছিলেন ৭০ জন।
লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ: নিরাপত্তার জন্য হুমকি
বিদ্রোহের সময় নরসিংদী ও শেরপুর কারাগার থেকে লুট হয় বিভিন্ন ধরনের ৯৪টি আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রায় ৯ হাজারের অধিক গোলাবারুদ। শুধুমাত্র নরসিংদী কারাগার থেকে লুট করা হয় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র ও আট হাজারের অধিক গোলাবারুদ। গত এক বছরে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এখনও পর্যন্ত ৬৫টি অস্ত্র এবং প্রায় ২ হাজার ৮২৩ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এখনও ২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ছয় হাজারে বেশি গোলাবারুদের কোনও হদিস নেই, যা নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নিরাপত্তা জোরদার ও নতুন উদ্যোগ
কারা অধিদফতর জানায়, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে কারাগারের সীমানাপ্রাচীর উঁচু করার পাশাপাশি বন্দিদের ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে ডিজিটাল রেকর্ড তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি কারাগারে আলাদা এনটিএমসি সিস্টেম চালু হচ্ছে, যাতে তথ্য সংরক্ষিত থাকবে।