উন্নয়নশীল দেশগুলিতে নির্বাচনি বৈতরণি পার হইতে এক নূতন কৌশল আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই আবিষ্কার অভিনবই বটে! তাহা হইল প্রতিপক্ষ দলের শীর্ষস্থানীয় বা গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা, সাজানো ও ভিত্তিহীন মামলা-মোকদ্দমা দিয়া তাহাদের জেলে ভরিয়া রাখা কিংবা কোর্ট-কাচারিতে তাহাদের দৌড়ের উপর রাখা। ইহাতে তাহারা হামলা-মামলার ভয়ে এমনিতেই আত্মগোপনে চলিয়া যান। জাতীয় নির্বাচন তো বটে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের সময়ও কোনো প্রকার ঝুঁকি নেওয়া হয় না। বৃহত্ গণতান্ত্রিক দেশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যের একজন মুখ্যমন্ত্রী অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে জেল হইতে ছাড়া পাইবার পর স্বাস্থ্যগত কারণে জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন জানাইয়াছিলেন; কিন্তু তাহাও নাকচ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহার অর্থ তাহাকে পহেলা জুন আবার জেলে যাইতে হইবে। দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি দেশে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জেলে রাখিয়াই আয়োজন করা হইল জাতীয় নির্বাচন। শুধু তাহার বিরুদ্ধেই নহে, তাহার বিবির বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়। এইভাবে খোঁজ লইলে নানা দৃষ্টান্ত ও চিত্র দেখিতে পাওয়া যাইবে। বিশেষ করিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ তো এক কাঠি সরেস। নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ জানাইতে পারে—এমন কোনো ‘কার্যকর’ বিরোধী দলই রাখে নাই দীর্ঘকাল ধরিয়া বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় থাকা সিপিপি। নির্বাচনের পূর্বে তাহারা সর্ববৃহৎ বিরোধী দলের নিবন্ধন পর্যন্ত বাতিল করিয়া দেয়। কী চমৎকার নির্বাচনি ব্যবস্থা!উগ্রপন্থি সংগঠন আল-কায়দার উত্থান একদা ছিল চোখে পড়িবার মতো। এখন আল-কায়দার অস্তিত্ব নাই বলিলেই চলে; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে এখন দেখা যাইতেছে এক নূতন কায়দা বা কলাকৗশল। বিরুদ্ধমতের রাজনীতিবিদরা এখন যাইবেন কোথায়? তাহারা এখন প্রমাদ গুনিতেছেন। তাহারা জেলে চলিয়া গেলে কি নির্বাচনের ট্রেন বসিয়া থাকিবে? নিশ্চয়ই নহে। এই জন্য রাতারাতি জাগিয়া উঠিয়াছে নূতন নূতন মুখ। বাহারি নামের ‘স্বতন্ত্র’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে তাহারা জয়লাভ করিয়া ‘তাক’ লাগাইয়া দিতেছেন বিশ্বকে। রাজনীতির এই নূতন ধারা কি গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর? নাকি নির্বাচনের প্রতি সাধারণ ভোটারদের আস্থা নষ্ট হইবার ইহাই মূল কারণ? দীর্ঘ মেয়াদে এই কায়দা বা কৌশল কি এই সকল দেশের জন্য আরো বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য ডাকিয়া আনিবে না?
বিশ্বের এমন দেশও রহিয়াছে যেইখানে বিদ্যমান শাসক নিজ উদ্যোগে সংবিধান পরিবর্তন করিয়া আজীবনের জন্য ক্ষমতায় থাকিবার বন্দোবস্ত করিয়া ফেলিয়াছেন। সংবিধান পরিবর্তন করিয়া প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদও বাড়ানো হইয়াছে নিজের ইচ্ছামতো। কাহারো কাহারো বিরুদ্ধে বিরোধীদের জেলে রাখিয়া মারিয়া ফেলিবারও অভিযোগ রহিয়াছে। ইহা কি আরো বিপজ্জনক নহে? তাহারা ইহা না করিয়া ইচ্ছা করিলে নির্বাচন নাও দিতে পারিতেন। যেইহেতু তাহাদের বিরোধিতা যাহারা করিতেছেন, তাহারা দমন-পীড়নের শিকার হইয়া দুর্বল হইতে দুর্বলতর হইয়া পড়িয়াছেন, তাই তাহাদের এত ভয় কীসের?
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, এক বত্সর বা তাহারও অধিক কাল হইতেই জেল-জুলুমের অপকৌশল অবলম্বন করা হয়। জাতীয় নেতা তো বটে, স্থানীয় নেতাকর্মীদেরও জেলে না রাখিয়া তাহারা শান্তিতে ঘুমাইতে পারেন না। অবশ্য নির্বাচন শেষ হইলেই কৌশলগত কারণে কেহ কেহ জামিনে ছাড়া পান। তবে তাহার পরও অনেককে আটকাইয়া রাখা হয়। আজ হউক বা কাল হউক, যখন পটপরিবর্তন হইবে, তখন রাজনীতির এই চল যে তাহাদের জন্য বুমেরাং হইবে না তাহারই-বা নিশ্চয়তা কোথায়?