গাবতলী বাস টার্মিনাল। ফাইল ছবি
কার্যকর পদক্ষেপে ব্যর্থতা হতাশাজনক
রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী-এই তিন বাস টার্মিনালকে ঘিরে যে চাঞ্চল্যকর চাঁদাবাজির চিত্র সোমবার যুগান্তরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, তা কেবল হতাশাজনক নয়, জাতির কপালে এক কলঙ্কের তিলক। ক্ষমতার পটপরিবর্তন বা গণ-অভ্যুত্থানের মতো বিশাল ঘটনার পরও যদি এই অরাজকতা সামান্যতম না কমে বরং রূপ পরিবর্তিত হয়ে বহাল থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এদেশে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনের কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। জানা যায়, রাজধানীর এই তিন টার্মিনাল থেকে বছরে কমপক্ষে ৩৬৩ কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলা হচ্ছে। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ বিভিন্ন নামে-বেনামে ও কোনো রসিদ ছাড়াই সাধারণ বাস মালিকদের জিম্মি করে আদায় করা হচ্ছে। এ অর্থ যাচ্ছে মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন, দুস্থ শ্রমিক পুনর্বাসন ও শ্রমিকদের কল্যাণের মতো বিভিন্ন খাতে, যার সুনির্দিষ্ট হিসাব-নিকাশ কেউই জানে না। এটি যে এক ধরনের সংঘবদ্ধ নৈরাজ্য, তা বলাই বাহুল্য।
পরিতাপের বিষয়, চাঁদাবাজির এই ‘স্বর্গরাজ্যে’ আগের মতোই প্রকাশ্যে ও পর্দার আড়ালে সক্রিয় রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি ও প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট কতিপয় বাস মালিক ও শ্রমিক নেতা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এই অপকর্মের নেতৃত্বে কেবল হাতবদল হয়েছে, মূল কাঠামো বা পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। অভিযোগ আছে, আগের ১৫ বছরেও ক্ষমতাশীল দুই দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে এই চাঁদার টাকা ভাগ করে নিতেন, আজও সে ধারা অব্যাহত আছে। ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীরা প্রকাশ্যে এলেও পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছেন নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারাই। বিশেষজ্ঞদের মতে, চাঁদাবাজি এদেশের রাজনীতিকদের চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও চাঁদাবাজির পরিবর্তন হয় না, শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটে।
সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশে চাঁদাবাজির অবসান হবে; কিন্তু বাস্তবে সেই প্রত্যাশা ধূলিসাৎ হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চাঁদাবাজির লাগাম টানতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। আইন প্রয়োগের দরকার ছিল। কিন্তু সরকার সেটা করতে পারেনি। এমনকি ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-দক্ষিণ) স্বীকারও করেছেন, বাস টার্মিনালগুলোতে চাঁদাবাজি অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’। তার দাবি, ভুক্তভোগীরা মুখ না খোলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হচ্ছে। দুঃখজনক যে, এমন বক্তব্য আগেও কর্তৃপক্ষের তরফে শোনা গেছে।
পরিবহণ খাতে এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের সড়ক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা কেবলই দিবাস্বপ্ন হয়েই থাকবে বলে মনে করি আমরা। উদ্বেগের সঙ্গে আমরা দেখছি, কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজির মাধ্যমে যে কালো টাকার অর্থনীতি সৃষ্টি হচ্ছে, তা পরিবহণ খাতের নৈরাজ্য আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারকে অবিলম্বে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও আইনের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে এই চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। শুধু মুখের কথায় নয়, নিতে হবে দৃশ্যমান পদক্ষেপ। অন্যথায় জনগণের প্রত্যাশার বিপরীতে এই অবাধ চাঁদাবাজি অদূর ভবিষ্যতে দেশের স্থিতিশীলতাকে আরও দুর্বল করে তুলবে। পরিবহণ খাতে নৈরাজ্য বন্ধে সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই প্রত্যাশা।