বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সোশ্যাল মিডিয়ার কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এবং ইনফ্লুয়েন্সারদের সরকারের পক্ষে ভিডিও তৈরির জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিলেন তৌহিদ আফ্রিদি। এমনকি ভয়ভীতি দেখিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেন অনেকে। তার সঙ্গে ছিলেন সোলায়মান সুখনও। এরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় এ দুজনকে নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা।
আখ্যায়িত করা হয়েছে নব্য রাজাকার হিসেবে।
আজ মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) অবশেষে এ প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন তৌহিদ উদ্দিন আফ্রিদি। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান এবং সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন সম্পর্কে দিয়েছেন বিস্ফোরক সব তথ্য।
পাঠকদের জন্য সেই পোস্টটি নিচে তুলে ধরা হলো:
আসলে আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে আমি কখনোই কিছু বলতে চাইনি।কারণ, আমি কিছু বলতে গেলে সেখানে আরও অনেকের নাম যুক্ত হবে। তাই আমি কাউকে দোষ না দিয়ে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। যতদূর জানি বোবার নাকি কোনো শত্রু থাকে না। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে শত্রু বেড়েই চলছে, সাথে বেড়েই চলছে আমাকে নিয়ে মিথ্যা বানোয়াট গল্পের সংখ্যা।
বাংলাদেশের যখন কোটা আন্দোলন শুরু হয় তখন আমি দুবাইতে ছিলাম। দেশের পরিস্থিতি তখন খুব খারাপ পর্যায়ে। আর তখন-ই আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করি, যে আমি দেশে আসছি এবং কোটা আন্দোলনকারী ভাইদের পাশে দাঁড়াবো। এই পোস্ট করার পরও আমি তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হইনি। এরপর আমি যখন শহীদ আবু সাঈদ ভাইয়ের ছবি আমার সকল সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে প্রোফাইল পিকচার এবং পোস্ট করি, তার কিছুক্ষণ পরেই আমাকে এনটিএমসি থেকে জিয়াউল আহসান কল দেয়। কল দিয়ে বলে “তোমাকে একটা জিনিস জানাতে চাই, তুমি যে রাষ্ট্রবিরোধী পোস্টগুলো দিয়েছো, এগুলো এক্ষুনি তোমাকে ডিলিট করতে হবে। আর তোমার সঙ্গে কে কে যুক্ত এগুলাতে?” এইটা শোনার পর আমি সাথে সাথে ফোনটা কেটে দিই।
এর কিছুক্ষণ পরেই আমাকে ডিবি হারুন কল দেয়। ডিবি হারুন আমাকে বলে ‘এই তুমি কার কল কাটছো? তুমি জানো? তুমি, তোমার বাবা, তোমাদের টেলিভিশন, সব শেষ করে দিবে। এখনি ওনাকে কল ব্যাক করো, যা বলে শুনো। ” এরপর সাথে সাথে কল কেটে দেয়। এরপর আমি ভয়ে পোস্ট ডিলিট করে দিই। আমার এখনো মনে আছে আমি সেদিন ভয়ে আমার পরিচিত কারোরই ফোন ধরিনি।
কিন্তু ডিবি হারুন আমাকে ফোন দিয়েই যাচ্ছিলো। এরপর দিন আবার ডিবি হারুন আমাকে ফোন দেয়। আমাকে বলে তোমার নামে ওয়ারেন্ট বের হইছে, দেশে আসলেই কিন্তু তুমি এয়ারপোর্ট থেকে গ্রেপ্তার হবা। তখন আমি বলি, চাচা আমি তো পোস্ট ডিলেট করে দিছি। আমি আরও বলি, চাচা পোস্ট তো আমি করি নাই। আমার অ্যাডমিন করছে। যদিও পোস্টটা আমি করেছিলাম কিন্তু তখন ভয়ে আমি তাকে এই মিথ্যাটা বলি। এটা শোনার পর উনি আমাকে বলে, “তোমার ওইসব অ্যাডমিন সরাও। ” এরপর উনি আমাকে একটা অ্যাকাউন্টের লিংক দিয়ে বলে “ওরে এক্সেস দাও”। এরপরে বাকিসব কিছু তো আপনারা দেখলেনই। ডিবি হারুন আমাকে আরও বলে, আফ্রিদি দেশে আইসাই তুমি আগে আমার সাথে দেখা করবা, তোমার নামে কিন্তু জঙ্গি মামলা হইছে।
এরপর আমি আমার বাবার সাথে সব শেয়ার করি। তখন বাবা আমাকে বলে যে “তুমি দেশে আসো। ফেসবুকে পোস্ট করা লাগবে না, তুমি রাস্তায় নামো, তাহলে তো সমস্যা নাই। ঠিক এরপর দিন থেকেই পুরো বাংলাদেশ শাটডাউন থাকে। যে কারনে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটও বন্ধ থাকে। আপনারা তা জানেন। এরপর যখন শাটডাউন শেষ হয় আমি বাংলাদেশে আসি, যদিও মনের ভেতরে একটা ভয় ছিলো যে এয়ারপোর্টে হইতো আমি অ্যারেস্ট হতে পারি। কিন্তু আল্লাহর রহমতে এয়ারপোর্টে কিছুই হয়নি।
বাংলাদেশে আসার পর আমি আর ডিবি হারুনের সাথে যোগাযোগ করিনি। কিন্তু পরের দিনই আমাকে আবার এনটিএমসি থেকে কল দিয়ে ডাকা হয়। তারপর ওইখানে আমি যাই। গিয়ে দেখি ওরা হলিউড মুভির কেস বোর্ডের মতো করে আমিসহ আরও কয়েকজন ইনফ্লুয়েন্সারদের ছবি টাঙিয়ে রেখেছে। আমার এখনো মনে আছে, ওদের একটিভিটিজ আমি আতঙ্কে একই জায়গায় ৩০ মিনিটের বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইনডিরেক্ট তো দূরের কথা ডিরেক্টলি ওরা আমাকে বুজিয়ে দিলো, কথার বাইরে গেলে সব শেষ আমার।
ওইদিন নাকি এরপর দিন রাতে আমার ঠিক মনে নাই, একটা এজেন্সি আমাকে জরুরি তলব করে। আমি এরপর সেখানে যাই। যাওয়ার একটাই কারণ, এর আগেও আমরা সব ইনফ্লুয়েন্সাররা ওদের সাথে কাজ করেছিলাম। এজেন্সি আমাকে বলে, “শুনো আফ্রিদি তুমি কার পক্ষে থাকবা বা বিপক্ষে থাকবা সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। তোমাকে ডাকার প্রধান কারণ হলো এই আন্দোলনে আমাদের দেশের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, যেমন ধরো মেট্রোরেল, সরকারি ভবনে ভাঙচুর ও আগুন এসব তো আর ছাত্রদের কাজ না। এগুলো তো সাধারণ মানুষেরই টাকাই বানানো। আর সরকার যদি ভুল করে সেটা নিয়ে অবশ্যই সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করা যাবে না। আর যারা যারা মারা গিয়েছে তাদের সুষ্ঠু বিচার চাইতে হবে। বুঝতেই পারছো, আমাদের মোটিভ হচ্ছে দেশের এই অবস্থায় সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেস ক্রিয়েট করা। সো, তুমি এবং তোমার পরিচিত যেসব ইনফ্লুয়েন্সার আছে তাদেরকে নিয়ে এই অ্যাওয়ারনেসটা সোশ্যালি করতে হবে। আমি এসব শুনে উনাকে ডিরেক্ট বললাম, ভাইয়া আমি তো এটা করতে পারবোই না, আর যারা আছে তাদেরকে যদি পাঁচগুণ টাকা বেশিও দেওয়া হয়, তাও তারা করবে না। এটা বিবেক আর ক্যারিয়ারের ব্যাপার।
তখন এজেন্সি আমাকে বলে, “আরে ভাই আমরা তো স্টুডেন্টদের বিপক্ষে পোস্ট দিচ্ছি না, আচ্ছা তুমি একটা মিটিং ফিক্সড করে দাও, বাকিটা আমি ওদেরকে বুঝিয়ে দেবো। এরপর আমি ওদের সাথে তাল মিলিয়ে হ্যাঁ, ওকে বলে ব্যাপারটা সেখানে শেষ করি। আপনারাই একবার চিন্তা করে দেখুন, এই অবস্থায় কেউ কী স্টুডেন্টদের পক্ষে ছাড়া ভিডিও বা পোস্ট করবে, পেমেন্ট যতই হোক? যাইহোক এরপর কয়েকজন ছোট ইনফ্লুয়েন্সারকে নিয়ে আমি ওদের সাথে মিটিং করিয়ে দিই। মিটিংয়ে এজেন্সি সবাইকে সবকিছু এক্সপ্লেইন করে। মিটিংয়ে সবাই পোস্ট এবং ভিডিও করার আশ্বাস দিলেও, মিটিং শেষে কেউ ভিডিও দিতে আর রাজি ছিল না। এমনকি অনেকেই টাকা নিয়েছে কিন্তু ভিডিও দেয়নি। এরপর এজেন্সি থেকে আমাকে সবার ভিডিওর জন্য আবার ফোন দেওয়া হলে, আমি ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করি। সবাই আমাকে জানায় এমন পরস্থিতিতে কেউ ভিডিও বা পোস্ট দিতে পারবে না। একটা সময় এজেন্সি যখন দেখলো আমার এবং বাকি ইনফ্লুয়েন্সারদের কেউ কিছু করতে রাজি হচ্ছে না, তখন তারা বলে এটলিস্ট, “সরকার যদি ভুল করে সেটা নিয়ে অবশ্যই সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করা যাবেনা” এই পোস্টটা করো, ভিডিও করার দরকার নাই।