মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইল সুষ্ঠু-স্থিতিশীল পরিবেশে বাঁচিয়া থাকিবার অধিকার এবং জীবনের সুরক্ষা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই জন্য সংঘাত ও সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হইয়াছে। একই সঙ্গে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে জননিরাপত্তার উপর। জাতিসংঘ কর্তৃক ব্যক্তি বা মানব নিরাপত্তা ঘোষণায় স্পষ্ট বলা হইয়াছে, ‘People have the right to live in freedom and dignity, free from poverty and despair…with an equal opportunity to enjoy all their rights and fully develop their human potential.’ জাতিসংঘের এই প্রস্তাবনার প্রতি বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থনও রহিয়াছে।
তথাপি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার পটভূমিতে ব্যক্তিজীবন অরক্ষিত হইয়া উঠিতে পারে হঠাৎ করিয়া। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিনিরাপত্তাহীনতার ঠিক এমনই এক ক্রান্তিকাল পার করিতেছি আমরা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়া গিয়াছে। ইহার ফলে বিঘ্নিত হইতেছে ব্যক্তিনিরাপত্তা। ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে ব্যবসায়-বাণিজ্যের পরিবেশ।
গণমাধ্যমগুলিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন হইতে জানা যায় যে, রাজধানীসহ সারা দেশে চুরি- ছিনতাই-ডাকাতি ব্যাপক বৃদ্ধি পাইয়াছে। শিক্ষার্থী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নানা পরিচয়ে বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাটে ডাকাতির ঘটনা ঘটিতেছে। সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয়ে বাড়ি বা ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়া তল্লাশি করিবার নামে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করা হইতেছে। বিয়েবাড়িতে পর্যন্ত অস্ত্রের মুখে জিম্মি করিয়া ডাকাতি চলিতেছে! চুরি-ছিনতাইসহ লুটতরাজের ঘটনাগুলিও নিয়মিত হইয়া উঠিয়াছে। কেবল এই সকল অরাজকতাই নহে, পাশাপাশি হামেশা ঘটিতেছে খুনখারাবিও। আর এই ক্ষেত্রে অধিকাংশ ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ করিতেছেন ভুক্তভোগীরা। ঘটনার আগে বা পরে পুলিশকে বারবার ফোন করা হইলেও ঠিকভাবে তাহাদের সাড়া পাওয়া যাইতেছে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে নিরুপায় হইয়া বাসাবাড়িতে লাঠি সংগ্রহে রাখিবার পরামর্শ দিতেছে বিভিন্ন আবাসিক ভবন সোসাইটি।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে উপনীত যে, কি ধনী কি গরিব- নিরাপত্তাহীনতার ভীতি গ্রাস করিতেছে সকলকে। বিভিন্ন আবাসিক এলাকা যেন হইয়া উঠিয়াছে উন্মুক্ত বাণিজ্যিক এলাকার ন্যায়! প্রতিবেশীরা এক বাড়ি হইতে অন্য বাড়িতে যাইতে পর্যন্ত ভয় পাইতেছে। অনেকে ভয়ে ঘরের দরজা অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখিতেছেন। সকলের ভয়-উৎকণ্ঠা এক জায়গাতেই-কখন হুট করিয়া কী হইয়া যায়!
কয়েক যুগ পূর্বেও এমন ছিল যে, সাধারণ নিরাপত্তাকর্মী কিংবা অফিস-আদালতের কেরানির পোশাক পরিহিত কাউকে দেখিলেই ভিতরে একধরনের সংযম আসিত! সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি সহসা মাথায় থাকিত। সেই দিন এখন আর নাই! অপরাধীরা অধিক দুঃসাহসী হইয়া উঠিয়াছে। তাহারা পুলিশ, র্যাব, এমনকি সেনাবাহিনীর পোশাক, ওয়াকিটকিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ন্যায় গাড়ি ব্যবহার করিতেও কুণ্ঠা বোধ করিতেছে না।
অন্যদিকে বর্তমান বাস্তবতায় বৃহৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশ সেইভাবে মাঠে কাজ করিতে পারিতেছে না। ফলে সমাজ-জীবন হইয়া পড়িয়াছে চরম অরক্ষিত। দুষ্কৃতকারীরা অনেকটা ফাঁকা মাঠে অপরাধ সংঘটিত করিবার প্রয়াস পাইতেছে। ইহার ফলে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে কী অবর্ণনীয় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা কেবল ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করিতে পারিবেন। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগ লইয়া সমাজকে এইভাবে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিশৃঙ্খলার অভয়ারণ্য করিয়া তুলিবার ফল কাহারো জন্যই সুখকর হইবে না। বরং ধর্মীয় অনুশাসনেও ইহা পরিত্যাজ্য। অশান্তি-বিশৃঙ্খলা তথা ফেতনা- ফ্যাসাদ সৃষ্টিকে পবিত্র কুরআনে হত্যার চাইতেও গুরুতর পাপ আখ্যায়িত করিয়া মহান আল্লাহ তায়ালা বলিয়াছেন, ‘ফেতনা (দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর পাপ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত, ১৯১)।
এমতাবস্থায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে জননিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়া রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বাহিনীগুলিকে কার্যকরভাবে মাঠে নামাইতে হইবে। সকল ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করিবার জন্য রুলস অব এনগেজমেন্ট অনুসারে যতটুকু ফোর্স প্রয়োগ করা দরকার, তাহা নির্দ্বিধায় করিতে হইবে। সংবিধানের ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদ সেই ক্ষমতা তাহাদের দিয়াছে। সুতরাং, সর্বাগ্রে বিবেচ্য হউক ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা।