বাড়ছে এডিস মশার ঘনত্ব। চলতি বছর আগের তুলনায় বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের হারও। এতে চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা আরও জটিল হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দ্রুতই কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে আক্রান্তের হার অন্য বছরের তুলনায় বেশি হবে। এবার ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি পৌরসভাগুলোকে সক্রিয় করতে হবে।
এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এ বছর এই সময় অন্য বছরের তুলনায় মশার ঘনত্ব বেশি। গত ৬ এপ্রিল এক দিনে প্রায় ৫২ জন আক্রান্ত হয়। অথচ গত বছর এই সময়ে এত আক্রান্ত ছিল না। আমাদের গবেষণা মূলত তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। গবেষণা অনুযায়ী মশার ঘনত্ব বেড়েছে। সে অনুযায়ী এ বছর অনেক বেশি এডিস মশা দ্বারা আক্রান্ত হবে মানুষ, যদি এখনি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। এবার ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগী হবে। সিটি করপোরেশনের মতো পৌরসভায় কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো কাঠামো নেই। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে মশা নিয়ন্ত্রণে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশন যে মশার কীটনাশক দিচ্ছে এটি পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া প্রতিবার এটি ল্যাব টেস্ট করে ছিটাতে হবে। এমনকি ছিটানো ওষুধও মাঠ থেকে নিয়ে টেস্ট করা উচিত। কারণ যারা এই মশার ওষুধ সরবরাহ করে তারা যে প্রতিবার প্রতি চালান ভালো ওষুধ দিয়েছে, সেটি তো টেস্ট করা ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে প্রথম তিন মাসে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ছিল ৮৪৩ জন। ২০২৪ সালে প্রথম তিন মাসে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৭০৫ জন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৯৯৭ জন। এর মধ্যে ৬২ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ ও ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ নারী রয়েছে।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ২০ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) চার জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) চার জন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এক জন করে রয়েছেন।
২০২৩ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় এবং মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৫৭৫ জন। চলতি বছর এযাবৎ ডেঙ্গুতে মোট ১৪ জন মারা গেছে।
বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়। দাবি করা হয়েছিল, সেই বছরে ৯৩ জন মারা যায়। এরপর তিন বছর পরে মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। তবে এটি আবার দেখা দেয় ২০১৮ সালে। সেই সময় ডেঙ্গুতে ২৬ জন মারা যায় এবং আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ১৪৮ জন। পরে গত ২৪ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে রোগটি ভয়াবহ আকার নেয়। সে বছর ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন।
ডেঙ্গু জ্বরের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। এ কারণে প্রতিরোধই এই রোগ থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উৎকৃষ্ট উপায়। আগে শুধু বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গুর বিস্তার, ঐ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এখন যেহেতু বৃষ্টির দিনের সময় বেড়েছে, তাই সারা বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ‘মশার উৎপাদন আগের চেয়ে কম হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ মশা নিয়ন্ত্রণের কাজকর্ম খুবই কম। আর হাসপাতালেও ডেঙ্গু চিকিৎসার যে বিকেন্দ্রীকরণ করার সিস্টেম, সেটা এখন নেই। যে অপারেশন প্ল্যান ছিল, সেটাও এখন স্থগিত; ব্যবস্থাপনা বরং আগের চেয়ে অগোছালো। আর ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু এ বছর বাড়বে কি না, তা নির্ভর করবে ডেঙ্গুর ভাইরাসের ধরন বা সেরোটাইপের ওপর। ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২-এ যদি এবার মানুষ আক্রান্ত হয়, তাহলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ খুব একটা হবে না। আর যদি সেরোটাইপ বা ধরন ডেন-৩ ও ৪ দিয়ে শুরু হয়, তাহলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং মৃত্যুও বেশি হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত ডেঙ্গু কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আপাতত আমরা আগের ওষুধ দিয়েই মশা মারব, সেটি কার্যকারিতা হারালে আমরা নতুন ওষুধের কথা চিন্তা করব।’
এ বিষয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জেনারেল ইমরুল কায়েসকে ফোন দিলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তিনি জানান, অফিশিয়াল সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।